বর্তমান সরকারের সময়কালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাফল্যঃ
ভুমিকাঃ
পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসল সারা বিশ্বে তুলার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আঁশ ফসল হিসাবে পরিচিত এবং বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। দেশের ৪০ থেকে ৪৫ লক্ষ চাষী প্রত্যক্ষভাবে পাট চাষের সাথে সম্পৃক্ত এবং পাট চাষ, পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাট ও পাট জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্যের ব্যবসার সাথে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পর্কিত। ১৯৮০ দশকের শুরুতে এদেশে কাঁচা পাটের উৎপাদন ছিল ৬০ থেকে ৬৫ লক্ষ বেল। ১৯৯০ দশকে শুরুতে এটি নেমে যায় ৪৪ থেকে ৪৭ লক্ষ বেলে। তবে সম্প্রতি পাট উৎপাদনে অগ্রগতি দৃশ্যমান। দেশের মোট রপ্তানী আয়ের ৩-৪% আসে পাট ও পাট জাত পণ্য থেকে। পাটের প্রাথমিক বাজার মূল্য বাবদ ৫০০০-৬০০০ কোটি টাকা দেশের রবি ফসলের পূজির যোগান দেয়। সুতরাং এদেশের কৃষি এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পাট খাতের অবদান অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। বর্তমানে বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কৃত্রিম তন্তুর ক্ষতিকর প্রভাব হতে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক তন্তু হিসাবে পাটের দিকে বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৭টি পণ্যে মোড়কীকরণে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে দেশে এবং বিদেশে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাটের জমি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ গড়ে ৭.০০ থেকে ৭.৫০ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে এবং গড়ে প্রায় ৭০-৮০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। তবে ২০১৭ সালে ৮.১৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করে ৯১.৭২ লক্ষ বেল পাট আঁশ উৎপাদিত হয়েছে, যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাটের আবাদি জমি ও উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এছাড়া পাট ফসল মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনবরতঃ ধান চাষের ফলে মাটির উপরের অংশে (Top Soil) খাদ্য উপাদান যে ঘাটতি দেখা দেয় পাটের প্রধান মূল মাটির গভীর থেকে খাদ্য উপাদান উপরে নিয়ে আসে। ফলে জমির উৎপাদনশীলতা তথা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যই শস্যক্রমে পাট অন্তর্ভূক্তি আবশ্যক। বাংলাদেশের জলবায়ু পাট চাষের জন্য এতই উপযোগী যে, পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম মানের পাট বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়।
সারণিঃ ২০০৫-০৬ অর্থ বছর হতে ২০১৬-১৭ বছর পর্যন্ত পাটের আবাদী জমি ও উৎপাদন
বছর |
আবাদী জমির পরিমান (লক্ষ হেক্টর) |
ফলন (টন/হেক্টর) |
উৎপাদন |
|
লক্ষ টন |
লক্ষ বেল |
|||
২০০৫-২০০৬ |
৪.০২ |
২.০৮ |
৮.৩৮ |
৪৬.০৯ |
২০০৬-২০০৭ |
৪.১৯ |
২.২০ |
৮.৮৬ |
৪৮.৭৩ |
২০০৭-২০০৮ |
৪.৪১ |
১.৯০ |
৮.৩৯ |
৪৬.১৫ |
২০০৮-২০০৯ |
৪.২০ |
২.০২ |
৮.৫২ |
৪৬.৮৬ |
২০০৯-২০১০ |
৪.১৬ |
২.২২ |
৯.২৫ |
৫০.৮৯ |
২০১০-২০১১ |
৭.০৮ |
২.১৫ |
১৫.২৬ |
৮৩.৯৫ |
২০১১-২০১২ |
৭.৬০ |
১.৯২ |
১৪.৫৮ |
৮০.২৩ |
২০১২-২০১৩ |
৬.৮১ |
২.০৩ |
১৩.৮৩ |
৭৬.১১ |
২০১৩-২০১৪ |
৬.৬৬ |
২.০৩ |
১৩.৫৭ |
৭৪.৩৬ |
২০১৪-২০১৫ |
৬.৭৩ |
২.০১ |
১৩.৫২ |
৭৫.০১ |
২০১৫-২০১৬* |
৭.২৫ |
১.৯০ |
১৩.৭৪ |
৭৫.৫৮ |
২০১৬-২০১৭* |
৮.১৭ |
২.০৪ |
১৬.৬৭ |
৯১.৭২ |
সূত্র: বিবিএস এবং *ডিএই
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) দেশের অন্যতম প্রাচীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিগত ১৯৩৬ সালে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির (ICJC) আওতায় ঢাকায় জুট এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ল্যাবরেটরী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে পাটের গবেষণা শুরু হয়। ১৯৫১ সালে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির (ICJC) স্থলে পাকিস্থান সেন্ট্রাল জুট কমিটি (PCJC) গঠিত হয় এবং বর্তমান স্থানে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে একটি এ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। বিজেআরআই বর্তমানে তিনটি ধারায় তার গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেঃ (১) পাটের কৃষি তথা পাটজাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন এর উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণা, (২) পাটের কারিগরী তথা মূল্য সংযোজিত বহুমুখী নতুন নতুন পাট পণ্য উদ্ভাবন ও প্রচলিত পাট পণ্যের মান উন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষণা এবং (৩) পাট এবং তুলা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আঁশের সংমিশ্রনে পাট জাত টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণা। পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের দেশী বিদেশী বীজ সংরক্ষণ ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য তৎকালিন ইন্টারন্যাশনাল জুট অর্গানাইজেশন (IJO) এর সহযোগিতায় ১৯৮২ সালে বিজেআরআইতে একটি জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জীন ব্যাংকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহিত পাট ও সমগোত্রীয় আঁশ ফসলের প্রায় ৬০০০ জার্মপ্লাজম সংরক্ষিত আছে।
এ পর্যন্ত পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের ৪৫ টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদ্ভাবিত ৪৫ টি জাত সমূহের মধ্যে ২০ টি জাত (দেশী পাটের ৯ টি, তোষা পাটের ৬ টি, কেনাফের ৩ টি এবং মেস্তার ২ টি) বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। এছাড়া পাটের কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকা-মাকড় ব্যবস্থাপনা, উন্নত পঁচন পদ্ধতি, পাট ভিত্তিক শস্য পর্যায়ে এবং বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রায় ৭০ টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাশাপাশি, পাটের বহুমূখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বল্প মুল্যের হালকা পাটের শপিং ব্যাগ, প্রাকৃতিক উৎস হতে রং আহরন করে পাটপণ্য রঞ্জন পদ্ধতি, পাটজাত শোষক তুলা, অগ্নিরোধী পাট বস্ত্র, জুট-প্লাস্টিক কম্পোজিট, সিনথেটিক উলের বিকল্প পাট উল ও পাট উলজাত সোয়েটার, পাট তুলাজাত সেনিটারী ন্যাপকিন ও বেবী ন্যাপকিন, বিভিন্ন ইনসুলেটিং ম্যাটেরিয়াল, জুট জিও-টেক্সটাইল, পাট এবং তুলার সংমিশ্রণে তৈরী বিভিন্ন পাটজাত টেক্সটাইল পণ্য যেমন পর্দার কাপড়, বেড কভার, সোফা কভার, জিন্স ইত্যাদিসহ প্রায় ৪০ টি বহুমূখী পাট পন্য ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়কালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাফল্যঃ